একগুচ্ছ কবিতা :: কুণাল সিংহ

0
361

সেতু

নদীটার নাম টুংটুং
এ নাম তুমি দিয়েছিলে।
লোকাল কোন নামতো নিশ্চিত আছে
অথবা ভৌগোলিক
যা ইচ্ছে হোক এ নদীর নাম টুংটুং।
সালটা মনে নেই। পুজোর একটু আগে
পরিকল্পনাহীন পৌঁছে গেছিলাম পাহাড় দেখব বলে।
নদীতীর ছুঁয়ে আছি চার হাত দিয়ে নদীজল
আমাদের উত্তরমাঠের বিপিনকাকা,পেশায় বাউল,
বলেছিল, নদীজলে পা দিও না
মেয়েমানুষের হৃদয়ের মতো নদী ব্যাথা পায়
তাই দুজনে ছুঁয়ে আছি জল চারহাত দিয়ে
কুলকুল জল যেন শিশুর স্বচ্ছ হৃদয়
এতটাই ঠান্ডা আয়না
পাথরনুড়ির আঁশ গুণে নেওয়া যায়
আঘাতে আঘাতে পাথরও কী অপরূপ নুড়ি হয়ে ওঠে!
বলা হয়নি একটা কথা,
যেখানে জল ছুঁয়ে আছি, অনতিদূরে
টুংটুঙের বুকের উপর একটি ব্রিজ শুয়ে আছে

ব্রিজটিও সুন্দর নদীটির মত
ব্রিজটিও মনোরম সুঠাম পুরুষ
আগলে রেখেছে এই পেলবস্রোতা
বুক পেতে দিনরাত পার করে দেয় কাদের যেন
বিপিনের কথামতো! ছুঁতে দেয় না জলের শরীর

পাহাড়কে সঙ্গে রেখে কত ছবি ধরেছিলে
বিকেলের আকাশের রঙিন অস্থিরতা
জলকে সঙ্গে নিয়ে অথবা পাতার আবডাল
কিংবা অনেকটা উঁচু পাকদন্ডী থেকে
ব্রিজটিকে ধরে রেখেছ লেন্সের ছায়ায়
কে জানে এতদিন পর ব্রিজটা কেমন আছে
কিংবা নদীটা!
এতদিন পর শরতের এই বন্দী বিকেলে নাড়তে নাড়তে
ব্রিজের কোন কোন ছবিতে আটকে যায় চোখ
ব্রিজটাকে অনেকসময় আমার বাবার মত লাগে।

 

বাস্তুতন্ত্র

কে মরেছে? কে মেরেছে?
কী প্রয়োজন জেনে
মানুষ মরেছে আর মানুষে মেরেছে
এইটি সত্য শুধু, বাকীটুকু চোখ ঠাওরানো

 

ভিতর পাড়ার গল্প 

আমাদের প্রত্যেকের একটা নিজস্ব গ্রাম আছে। শহর নয়।
শহর গড়তে হয়। গ্রাম’ত গড়াই থাকে। সে নিজেকে সাজাবে বলে ললন্তিকার মত বনষ্পতি। দুলের মত পাতা। নাভিকোটরে যার সারি দেওয়া পিঁপড়ের সংসার। পিঠছড়ানো চুল ঢলেপড়া ঢেউ ধানক্ষেত। চোখ সে’ত ছোটবড় সব দুঃখ মিলেমিশে কাকচক্ষু ডাগর তালদিঘী। বুকের উঠোনে স্তুপাকৃতি পাকা ধান। কবে যে শরীর চিরে পাদুটো ঘাসওঠা সিঁথিকাটা আঁকাবাঁকা রাস্তা হয়ে গেছে। যেখানে রাস্তা শুরু সেখানে গমের বীজের মতন অপেক্ষা করে থাকেন জীবন। কয়েক ফোঁটার অপেক্ষা। তারপর শ্রাবণ জীবন। ছিটকে ওঠে। পদ্মপাতায় সাতরঙ টলোমলো। ওইখানে গ্রামজন্ম হয়। প্রত্যেকের একটা নিজস্ব গ্রাম আছে। দুঃখের মত। মুহূর্তের আনন্দ ঘৃণা লালসার মত। তবুও শাঁখ বাজে। চিরাচরিতের মত ডেকে আনা হয়। প্রদীপের নিচে অন্ধকারে আলপনা জেগে থাকে। হারিয়ে যায় কত নাকছাবি! পীনোন্নত ধ্যাবড়া ছাপা শাড়ি কতবার শুকিয়েছে গায়ে। অন্ধকারে গুগলি কুড়োনোর মত স্মৃতি হাতড়ায় । আমাদের ভিতর পাড়ায়। বস্তুত
প্রতিটি গ্রামই যেন রোগা কালো মেয়ের নিজস্ব বহুরঙের কষ্ট।

 

দোল

কবে যেন দূর সোনাঝুরি
রং ঝরেছিল
কারা যেন এসেছিল
রেখে গেল অনেকটা যৌবন।
ঝরাপাতা ঝরে গেলে নেশার মত
আগুন লাগল ঐ চৈত্রের রোদে
চিকচিক করে ওঠে পলিথিন পেপারের যেন
কচি লাল আমপাতা ঠোঁট
কৃষ্ণচূড়া গাছের পেছনে
আগুন লাগানো কোন বসন্ত উৎসব

 

দাহ্য

এখনও সূ্র্য পুড়ছে

এই সেদিনও আকন্ঠ চুম্বন
পান করে দেখেছি। এখনও
আলজিভের পেছনে গনগনে
সূর্য ওঠে শরীরের নিঃসীম গহ্বর থেকে

এখনও ছাই ওড়ে

জ্বলে যায় দাউদাউ আদিগন্ত তক্তাপোশ
সূ্র্য ওঠা শেষ হলে
বুকের ওপর লেপটে থাকে ভারী বক্ষদেশ
তীরবিদ্ধ পাখি যেন আছড়ে পড়েছে
বধ্য নিষাদের স্বেদসিক্ত বুকে

এখনও সূ্র্য পোড়ে ছাই ওড়ে
বুকের ভিতরে
আমাদের পাশের পাড়ায়

 

যাবে নাকি নরকে

চাঁদ,আমার কিছুটা কষ্ট নাও,সবটা নয়
তাহলে তোমার কিছুটা কলঙ্ক
মোচন হবে এই অবেলায়।
সবটা নিলে দ্বিতীয়বার ডাকব কেমন করে!
তোমায় পেতে
স্বর্গকে, দাঁড়াও আসছি, বলে
বারবার পথে নেমেছি যেদিকে নরক।
চলতে চলতে নিজেকে ভীষণ চেনা…
অসহায় লাগে না এক লহমাও
জল থেকে তুলে নেওয়া মাছের মত
কোথাও রাস্তা নেই দারুণ সোজা পথ গড়িয়ে গেছে
কোথাও উদ্যান নেই জ্যোৎস্না ভেঙেচুড়ে ঢুকে পড়া
মুখর অরণ্য
প্রতিটা ঘাসের ডগা তোমার আলোয় নিজস্ব
মতামতে প্রতীয়মান দাঁড়িকাটা ব্লেডের মত
প্রতিটি তারা খসে পড়তে চায়ছে বুকের কাপড় সরিয়ে
যে কাপড় রূপোলী সোঁতা হয়ে বয়ে যাচ্ছে অসভ্য
অববাহিকার দিকে
মোহনায় নদীখাতে লাফিয়ে পড়বে রূপোলী জ্যোৎস্নামাছ
যেভাবে লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু ঝাঁপিয়ে পড়ে
একটি মর্দানী ডিম্বাণুর দিকে। যত রাত বাড়ে
গাছের নিচের জ্যোৎস্না খোঁজে বিপবিপ
ফ্লুরোসেন্ট জোনাকির আলো
টিপে টিপে মেরে ফেলবে বলে….
সারারাত আমার কষ্ট নিতে নিতে পাশ ফিরে শুলে
ক্রমশ ফিকে হোচ্ছ দিনের আলোর মত।
ভোর।

কানে কানে বলে রাখি:
ভোরের কুয়াশার মত নরক বড্ড সুন্দর!