মাহমুদ দারবিশের কবিতা

0
107

মাহমুদ দারবিশের কবিতা

অনুবাদ- সায়ন ভট্টাচার্য

কবি মাহমুদ দারবিশ ( Mahmoud Darwish)-কে মনে করা হয় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনের কণ্ঠস্বর। তাঁর জন্ম ১৯৪১-এর ১৩ মার্চ ফিলিস্তিনের পশ্চিম গালিলি’র আল-বিরওয়া গ্রামে। ৯ আগস্ট,২০০৮ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হাউস্টন শহরে প্রয়াত হন। জীবৎকালেই ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান মাহমুদ। লেখককে ফরাসি সরকার Ordre des Arts et des Lettres এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘লেনিন শান্তি পুরস্কার’সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

ফিলিস্তিনে ইজরায়েল ও তার পশ্চিমা দোসরদের আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৪-তে লেখা কবিতা ‘আইডি কার্ড’, যা তার অন্যতম প্রধান কবিতা, ২০১৬’র জুলাইয়ে গান হিসেবে সম্প্রচারিত হয়ে বিশ্বব্যাপী বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করে। এখানে তাঁর এই কবিতাটি এবং আরো একটি বিখ্যাত কবিতা অনুবাদ করে দিলাম পাঠকবর্গের জন্যে।

কবিতা দুটো অবশ্যই দারবিশের মাতৃভাষা আরবিতে লেখা। আমি এখানে অনুবাদে অনুসরণ করেছি প্রথমটির ক্ষেত্রে সালমান মাসালিয়া (Salman Masalha) আর ভিভিয়ান ইডেন (Vivian Eden)-এর করা এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সারাহ্‌ মাগির (Sarah Maguire) ও সাব্রি হাফেজ (Sabry Hafez)-এর করা ইংরেজি তরজমা।

আইডি কার্ড

লিখে রেখো
আমি একজন আরব।
আমার আইডি কার্ড নম্বর ৫০,০০০।
আমার সন্তান: আটটি
এবং এই গ্রীষ্মের পরপরই জন্ম নিতে যাচ্ছে নয় নম্বরেরটা।
তুমি কি রেগে যাচ্ছো?

*
লিখে নাও:
আমি একজন আরব।
আমি খাদানে কাজ করি আমার মেহনতি কমরেডদের সঙ্গে।
ছেলেমেয়ে আটজন আর আমি জীবনের
পাথর ঠেলে তার মধ্যে থেকে বের করে আনি রুটি, কাপড়চোপড় আর নিজের লেখার কাগজ।
তোমাদের দুয়ারে গিয়ে ভিক্ষে করি না,
লেহন করি না তোমাদের দরজার সিঁড়িতে বসানো টালি।
তাতে কি তোমার রাগ হয়?

*
লিখে নাও:
আমি একজন আরব।
পদবীহীন একটা নাম,
রোগগ্রস্ত এমন একটা দেশে থাকি যেখানে সবকিছু বেঁচে আছে ঝলসানো রাগ নিয়ে।
আমার শেকড়…
সুদৃঢ়ভাবে গাঁথা সময়ের জন্মদাগ – আগে থেকেই, যুগ শুরুর আগে থেকেই,
সাইপ্রেস আর জলপাই গাছের আগে থেকেই,
চারণভূমি সৃষ্টির আগে থেকেই,
আমার বাবা… চাষাভুষোদের একজন,
অভিজাত প্রভুদের কেউ নন।
আমার দাদু একজন কৃষক
বলার মতো নেই কোনো বংশপরিচয়,
আমি বই পড়তে শেখার আগেই
আমাকে শেখানো হয় আত্মমর্যাদা।
কুঁড়েঘর বেড়া আর খুঁটিতে গড়া বাড়িতে আমার বাস ।
আমার অবস্থায় তুমি কি খুশি?
আমি পদবীহীন শুধু একটি নাম

*
লিখে নাও:
আমি একজন আরব। কয়লা-কালো চুল,
চোখ বাদামি,
পরিচয়জ্ঞাপক বিশেষ চিহ্ন:
মাথায় একটা কেফিয়েহ্ আর তার ওপরে ঈগাল, আমার হাতের তাল পাথরের মতো রুক্ষ,
কেউ ছুঁতে গেলেই ঘষটে যায়।
আমার ঠিকানা:
একটি নিরস্ত্র গ্রাম– বিস্মৃত–
যার রাস্তাগুলো নামহীন,
এবং যার সমস্ত লোকজন ক্ষেতে কিংবা খাদানে।
তুমি কি রেগে যাচ্ছো?

*
লিখে নাও:
আমি একজন আরব
আমার পূর্বপুরুষদের আঙুরক্ষেতগুলো থেকে আমার আর আমার সন্তানদের
চাষ করা জমি থেকে বিতাড়িত।
আমার নাতি-নাতনিদের জন্যে কিছু আর অবশিষ্ট নেই শুধু কয়েকটা পাথরখন্ড ছাড়া…
তোমাদের সরকার কি সেগুলোও নিয়ে নেবে,
রিপোর্টে যেমনটা বলা হচ্ছে?
তাই,
পয়লা পৃষ্ঠার শুরুতেই লিখে নাও:
আমি কাউকে ঘৃণা করি না,
আমি কারুর ওপর হামলা করতে চাই না
কিন্তু… আমার ক্ষিধে পেয়ে গেলে
আমার দখলদারদের রক্তমাংস খেয়ে ফেলি।
হুঁশিয়ার… সাবধান… আমার ক্ষিধের ব্যাপারে,
এবং আমার ক্রোধের ব্যাপারে আমি অজ্ঞ।

অন্য বর্বরেরা আসবে

আরো বর্বরেরা আসবে।
চুরি হবে সম্রাটের স্ত্রী।
দামামা বাজবে উলম্ফন।
দামামা বাজবে, ঈজীয় সাগর থেকে দার্দানেলিস পর্যন্ত
ঘোড়ারা ছিন্নভিন্ন ছুটতে পারে
একসাগর লাশ।
তা বলে আমাদের ভাবনা কিসের?
ঘোড়দৌড় নিয়ে আমাদের স্ত্রীদের আছে কী কোনও কাজ?

চুরি হবে সম্রাটের স্ত্রী।
দামামা বাজবে উচ্চশব্দে এবং আরো বর্বর
আসবে। বর্বরে বর্বরে ভরে যাবে শহরের শূন্যতা,
উন্মত্ততা এক সময় উত্তাল হবে সমুদ্রের চেয়ে,
একটু বেশি শক্তিশালী হবে তলোয়ারের চেয়ে।
তা বলে আমাদের ভাবনা কিসের?
ঔদ্ধত্য শিশুদের সঙ্গে
আমাদের সন্তানদের কী কাজ?

দামামা বাজবে ভয়াল শব্দে
এবং আরো বর্বরেরা আসবে।
সম্রাটের স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে
তাঁর শয়নকক্ষ থেকে।
রাজপ্রাসাদ থেকেই শুরু হবে সামরিক আক্রমণ,
সম্রাটের বিয়ের কনেকে ফিরিয়ে আনতে তাঁর শয্যায়।
তা হলে আমাদের ভাবনা কিসের?
তাড়াহুড়োর এই বিয়ের ব্যাপারে
কী করার আছে পঞ্চাশ হাজার লাশের?

আমাদের মধ্যে থেকে কি হোমারের জন্ম হবে আবার…
আর পুরাকাহিনীতে ঠাঁই পেয়ে যাবে জনগণও?