প্রতিবাদের ভিন্ন স্বর: কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত

0
434
মল্লিকা সেনগুপ্ত

শিবানী মণ্ডল
গবেষক, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়

আজ কবি ও লেখক মল্লিকা সেনগুপ্তের জন্মদিন। তাঁর কবিতায় প্রতিবাদের যে ভিন্ন স্বর ফুটে উঠেছে তার জন্যই কবি হিসাবে তিনি অনন্য। আজ সেই প্রতিবাদের জন্মদিন। হাজার হাজার নারীকে যিনি তাঁর লেখনীর আঁচড়ে লড়াই করতে শিখিয়েছেন, নিজের জন্য বাঁচতে শিখিয়েছেন সেই সাহসী কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত আজকের দিনেই অর্থাৎ ১৯৬০ সালের ২৭শে মার্চ নদীয়া জেলায় জন্মগ্রহন করেছিলেন। কবির পিতা সরকারী কর্মী হওয়ায় শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে। পরবর্তীকালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকোত্তর পড়াশোনা করে ‘বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছিন্ন নারীদের উপস্থাপনার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ নামক বিষয়ে গবেষণা করেন। কর্মসূত্রে তিনি মহারানী কাশীশ্বরী কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ১৪ টি কবিতার বই, ৩টি উপন্যাস, ৩টি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং অনুবাদগ্রন্থ লিখে সাড়া জাগিয়ে দিয়েছিলেন পাঠক মহলে। সুকান্ত পুরস্কার, কেন্দ্রীয় সরকারের জুনিয়র রাইটার্স ফেলোশিপ, আলপনা আচার্য স্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির অনীতা-সুনীল বসু পুরস্কার ইত্যাদি পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। ভারতীয় লেখক প্রতিনিধি হিসাবে অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ইত্যাদি দেশে কবিতা পাঠ করেছিলেন। সানন্দা পত্রিকার কবিতা বিভাগে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। কবি, লেখক সুবোধ সরকারের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়ে যৌথভাবে ভাষানগর অর্থাৎ এই পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। তাঁর একসময়ের সম্পাদিত পত্রিকাতে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার সৌভাগ্য হয়েছে, সেজন্য আমি যারপরনাই আপ্লুত, আনন্দিত। তাঁকে নিয়ে লিখতে বসলে এতগুলি ভিন্ন বিষয় মাথায় ঘোরাঘুরি করে যা স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা কঠিন তবু, আজকের দিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী স্বরূপ তাঁকে নিয়ে কয়েকটি কথা না লিখলেই নয়।

বেদ, পুরাণ থেকে শুরু করে বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে নিয়ে যে এতভাবে এত সুন্দর করে বিশ্লেষণ করা যায় তা তাঁর কবিতা না পড়লে জানা যেত না। এর প্রমাণ আমরা ‘চল্লিশ চাঁদের আয়ু’ থেকে শুরু করে ‘কবির বৌঠান’ এর মধ্যে পাই। ‘সীতায়ন’ উপন্যাসে রামায়ণকে তিনি দেখিয়েছেন নতুনভাবে। রামায়ণের ঘটনাকে সীতার দৃষ্টিকোন অর্থাৎ এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে কল্পনা করেছেন। সতীত্বের প্রশ্ন করা রামের প্রতি সীতার উক্তি-

“আমার জীবন তো শেষ হল। পরন্তু সতীত্বের শপথ নিয়ে আর্যাবর্তের সমগ্র নারীদের সর্বনাশের পথ সুগম করতে পারব না”।

প্রচলিত ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ রামকে উদ্দেশ্য করে সীতার মুখ দিয়ে যেভাবে তিনি কথাগুলো বলেছেন তা হয়তো তিনি ছাড়া আর কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সময় যত এগিয়েছে তাঁর সৃষ্টি তত পরিপুষ্ট হয়েছে। সহজ অথচ বলিষ্ঠ শব্দে নারীর পক্ষ নিয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতন্ত্র নামক এক প্রথার বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। পুরুষ বিদ্বেষ নয় বরং তিনি পুরুষের পাশে মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র শিখিয়েছেন। দেশবিদেশের বিভিন্ন ঘটনা, অজানা শব্দ, সেগুলির অসাধারণ প্রয়োগ কৌশলে তাঁর কবিতা একদিকে যেমন নতুন নতুন বিষয়াবলীর সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘটিয়েছে, অন্যদিকে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র যা আমাদের লড়াইও করতে শিখিয়েছে। আমরা যারা তাঁর কবিতা পড়ে মনে মনে লড়াইয়ের শক্তি পাই তাদের মধ্যেই তিনি বেঁচে আছেন।

‘পুরুষ নয় পুরুষতন্ত্র’ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন- “আমি আমার কথাই লিখব, আমাদের কথা, যুদ্ধের জন্য কলম হাতে তুলে নেব, বারবার।” আজীবন তিনি সেই সব অবহেলিত নিপীড়িত মেয়েদের কথা লিখে গেছেন, নিজেকেও তাদের একজন মনে করেছেন, কলম দিয়েই তাদের জন্য লড়াই করেছেন। শেষবেলায় ‘আমাকে সারিয়ে দাও ভালোবাসা’ কাব্যগ্রন্থটি পড়লে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এমন একজন অদম্য সাহসী, প্রানবন্ত মানুষ ভালোবাসার কাছে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করছেন। জীবনের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা এবং সন্তান, স্বামী, ভাই, মা সর্বোপরি প্রতিবাদী মেয়েদের জন্য তিনি আরো দু-দশ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন কিন্তু উটে চড়ে, টোটো করে রাজস্থান ঘুরে বেড়ানো, আগুন ঘিরে উৎসব নাচা গানা করার ইচ্ছে তাঁর আর পূরণ হয়নি কিন্তু অজস্র মানুষের ভালোবাসায় তিনি অমর হয়েছেন। ২০১১ সালের ২৮শে মে প্রাণঘাতী কর্কট রোগ তাঁকে ইচ্ছে অপূর্ণ রেখেই চলে যেতে বাধ্য করেন। স্বামী সুবোধ সরকার স্মৃতিকথায় লিখেছেন মল্লিকার কথা, যখন তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কর্কট রোগের সঙ্গে লড়াই করছেন তখনও তিনি বাঁচার কথা বলতেন- “আমার মাথায় আবার চুল আসবে, নতুন চুল, নতুন শাড়ি পরে আবার আমি কলেজ যাব, এক ঘর ছাত্রীর সামনে দাঁড়াব। উঠে দাঁড়িয়ে ছাত্রীরা গাইবে আগুনের পরশমণি….” তাদের আর গাওয়া হয়নি কিন্তু কবি মল্লিকা ছিলেন সত্যিকারের পরশমণি। কর্কট রোগ হয়ত তাঁর শরীর কেড়ে নিয়েছে কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি যোদ্ধা মল্লিকাকে। আজকের মেয়েদের মধ্যেই তিনি বিরাজমান। তিনি লিখেছিলেন-

“আমার কবিতা অসহায় যত পাগলি মেয়ের প্রলাপ

আমার কবিতা পোড়া ইরাকের ধবংসে রক্তগোলাপ

কবিতা আমার মেধা পাটেকর

শাহবানু থেকে গঙ্গা

আমার কবিতা অলক্ষ্মীদের

বেঁচে থাকবার সংজ্ঞা।”

তিনি মাটির দূর্গাকে স্থাপনা করেছেন রক্ত-মাংসের দূর্গার মধ্যে- “আমার দূর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে”। আজকের মেয়েরা নিজের জন্য বাঁচবে এইটুকুই তো তিনি চেয়েছিলেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। বহুদিন হল শক্তিশালী কর্কট রোগের কাছে ধরাশায়ী হয়ে চলে গেছেন। কেবল রয়ে গেছে কবিতার মাধ্যমে তাঁর জ্বালিয়ে যাওয়া আগুন যা আজও অসংখ্য মেয়েকে সাহস জোগাচ্ছে, ভবিষ্যতেও জোগাবে। একদিন এই পৃথিবীর সব মেয়েরা নিজেদের অধিকার আদায় করে নেবে, পুরুষতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষকে পাশে নিয়ে পথ চলবে, সমানাধিকারের মুক্তকন্ঠে সমাজ তাদেরকেও মানুষ ভাববে- ঠিক এমনই একটা দিন তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। যতদিন না সেই দিন আসবে ততদিন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত একইভাবে প্রাসঙ্গিক।