রোজমেরি ডানের কবিতা | অনুবাদ: অরিন্দম রায়

0
188

শ্রীমতী মারাদোনা

ব্যাপারটা চিরকাল এমন ছিল না,
পুরনো দিনগুলোতে, আমরা শ্যাম্পেন খেতাম,
গোলাপ ফুল, আর জেটসেট লাইফস্টাইল
ওর ঐ শক্তপোক্ত
দৃঢ় কাঠামোর মধ্যে
কিছু একটা ব্যাপার ছিল,
প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিলাম
মাঠের মধ্যে,
হুম, মনে হচ্ছিল যেন কোনও দেবদূত ওর পায়ে চুমু খেয়েছে
আর ওকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে।
আমিই প্রথম ওকে সেই নাম দিয়েছিলাম ___
ডানাওয়ালা দূত:
গোলের মুক্তিদাতা।

ও হাসত, আমাকে বলত
এসব চিরকাল টিকবে না , আর তাতে কিছু আসে যায় না।
কিন্তু রাত্রিবেলা, পিশাচদের বিদ্রুপ শুনে চিৎকার করে ঘুম থেকেউঠে বসত,
যারা ওর কানের কাছে ফিসফিস করত যখন ও ঘুমোত,
ওর প্রতিভার দুর্বলতম জায়গা নিয়ে,
আর কিভাবে একদিন এই সবকিছু উধাও হয়ে যাবে।
কিন্তু আমার জন্য , এটা যথেষ্ট ছিল, এবং আছে,
ওর ঠিক পাশে শুয়ে থাকা,
আর অনুভব করা যে ওর স্পর্শ হল
ঈশ্বরের হাতের ছোঁয়া।

ফুটবল

ফুটবল কামনা করছে আমি ছিলাম ক্রিশ্চিয়ানোর বান্ধবী,
একটা জিঙ্গল গাওয়া হচ্ছে স্বতন্ত্র আর আনকোরা
গলায়,
মাঠে একদল খেলোয়াড় আর কাকুতিমিনতি করতে থাকা দর্শকের ভিড়।
দর্শকেরা হনুমানের মতো হুপ হুপ আওয়াজ করছে
খেলোয়াড়রা মাঠের মধ্যে পাগলের মতো দৌড়চ্ছে
যখন তারা গোল করছে __ আমি পাগল উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি!
ফুটবল মানসিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে
তবুও এই খেলাটা তোমার আর আমার জন্য তৈরি।

ফূটবল খেলা খুব একটা কঠিন নয় ___ যদি তুমি আমার মতো হও!
যতক্ষণ না তুমি গায়ে কাদা মাখছ আর গা থেকে দুর্গন্ধ ছাড়ছে ততক্ষণ এতে কোনও মজাই নেই।
যারা ভীতু আর যারা সহজেই হাল ছেড়ে দেয় তাদের জন্য ফুটবল নয়
আর, না এটা মাতাল হয়ে নিজের বউকে পেটানোর তোমার কোন অজুহাত।

ফুটবল সুগন্ধি-ল্যাভেন্ডার মাখা মহিলারা নয়
এবং ফুটবল চিড়িয়াখানায় খেলা হয় না।

প্রশংসায়

আমি ফুটবল পছন্দ করি
আমার বন্ধুরা তারা সকলেই জানে।
হ্যাঁ, বাস্তবিক,
আমি ফুটবল পছন্দ করি, এটা একটা দেখার মতো ব্যাপার হয়
যখন আমি ছোট পিজ্জা
আর কোক নিয়ে বসি
ঐ লোকটার দিকে
বাড়ানো পাসের গুণাগুন নিয়ে আলোচনা করি।

এমনকি আমি অফ-সাইডের নিয়মকানুনও আয়ত্ত করেছি
এটা আমার এলাকা, আর আমি
টিভিতে যা-ই দেখানো হোক না কেন
ফুটবল ম্যাচই দেখি।
একজন অন্ধভক্ত
যদিও আমার স্বীকার করা উচিত
ঠিক ফুটবল খেলা নয়
বরং ফুটবলারদের পা’গুলো দেখি।

আমি জানি ব্যাপারটা সেক্সিস্ট।
এত বেশি আচ্ছন্ন থাকাও ভালো নয়।
কিন্তু আমি কিছুই করতে পারি না
ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আমি চেয়ারটাকে টিভির আরও সামনে টেনে নিয়ে বসি,
প্রায় টিভি স্ক্রিনের ভিতরে ঢুকে যাই
আমি আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে চাই
তাদের মোজায় আটকানো পিনগুলো
ক্লোজ আপের দৃশ্যগুলো স্বর্গীয় বলে মনে হয়
অ্যাকশন রিপ্লে , আমি দেখি।
বারবার দেখেও আমি তৃপ্ত হই না
ঐ দৃঢ় মালাইচাকি,
গ্রন্থিময় উরুর মাংসপেশি
পায়ের গুলির গ্যাস্ট্রোকনিমিয়াস পেশির বাঁক
আমি এই সমস্তকিছু অ্যানাটমি বই পড়ে জেনেছি,
কিন্তু টানটান অবস্থায় তাদের কাজ করতে দেখা
আর সেগুলো সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পারা
আমার কাছে মেয়েদের সত্যিকারের ভালো সময় কাটানোর এটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আর যাহাতক গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস এর প্রসারণের কথা
সাটিন কাপড়ের ছোট হাফপ্যান্টের ভিতর দিয়ে
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ কঠোর অনুশীলনের জন্য!
ওইসব পেশিবহুল জিনিস কখনই আমার যথেষ্ট বলে মনে হয় না।
আমি জানি
এইভাবে পুরুষদের নিছক বস্তু হিসেবে দেখাটা নিঃসন্দেহে সেক্সিস্ট।
একদৃষ্টে দেহের অংশের দিকে তাকিয়ে থাকা
বাস্তবিক আপত্তিকর।

কিন্তু আমি ভালোবাসি, ঐ পা’গুলো
ওগুলো আমাকে কিছু একটা করে দেয়।
তারা কী প্রত্যাশা করে?
তারা এটা চায়, সত্যি?
যৎসামান্য ছোট হাফপ্যান্ট পরে
তাদের খেলাধুলোর নামে
যখন তারা তাদের শরীর প্রদর্শন করে।
এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যখনই তারা গোল করে আমি লাফ দিয়ে উঠি,
যদিও আমি চেষ্টা করি আর চিৎকার করি ‘ইয়াহ’!
সেটা শুনতে লাগে ‘পাওয়ার’!

আমি পরোয়া করি না যদি এর কোন চিকিৎসা থেকে থাকে,
আমি নিজেকে পাল্টাতে চাই না,
আমি যা তাই নিয়েই আমি সন্তুষ্ট
একজন ফুটবল সমর্থক___
এবং ফুটবল খেলা পা-এর একজন বিশাল বড় ভক্ত।

• গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস হল মানবদেহের দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে ভারী পেশি।

ফুটবলের অনিশ্চয়তা

আমি একজন ফুটবলার
আমি ফুটবল খেলা খুব পছন্দ করি।

আমি ফুটবল
আমি ফুটবলারকে খুব পছন্দ করি।

আমি ফুটবল খেলার একজন ফুটবলার
আমার খুব পছন্দের।

একজন প্রিয় ফুটবলার যার পছন্দ ‘ আমি , আমি’ ___
খুব ফুটবল।

পছন্দের ‘আমি কি ফুটবল?’
আমি কি?___ একজন খুব ফুটবলার।

একজন ফুটবলারের ফুটবল!
আমার পছন্দ ? আমি কি খুব ?

ফুটবলারের ফুটবল! আমি।
আমার খুব পছন্দের একটি ‘খুব’।

আমি যার খুব পছন্দ ফুটবল।
আমি কি একজন ফুটবলার?

 

মেয়েদের জন্য এটা আলাদা

যখন আমি ছোট ছিলাম , আমি আমার
বাবা আরা ভাইদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম।
আমি ড্রিবলিং-এ দক্ষ ছিলাম __
হেড করাতেও।

বলটাকে পায়ে করে নাচাতে নাচাতে

আমি এগিয়ে যেতাম,
বলটাকে সামনের দিকে লাথিয়ে,
এক চুল জায়গা দিয়ে,
যখন আমি মার্টিনকে ডজ করে
বাবার দিকে এগিয়ে যেতাম,
যিনি গোলপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে।
‘‘বলটা পাস কর!’’ মার্টিন চেল্লাত
‘‘আহা রে বেচারা! এটা আমার’’।
তারপর, ও যতক্ষণে আমায় ফেলে দিতে পারে
একটা উড়ন্ত ট্যাকলে
আমি বলটায় লাথি মারতাম
বাবার ডানদিক ঘেঁষে আর সোওজা জালে!
গোল!

হ্যাঁ…!

জুনিয়র লেভেলে
আমরা স্কুলের মাঠে সবাই মিলে ‘ফুটি’ খেলতাম
যখন আমরা ছিলাম
যৌনলক্ষণহীন
এবং শুধুমাত্র বাচ্চা।

আর যখন অন্যান্য মেয়েরা খেলতে শুরু করে দিয়েছিল
চুমু চুমু খেলা,
মা আর বাবা খেলা,
আমি ফুটবল খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

‘‘রোজি একটা টমবয়!’’
তারা টিটকিরি দিত।
কিন্তু আমি খুশি ছিলাম,
ফুটবলে লাথি মেরে
গর্ব বোধ করতাম
ছেলেদের মধ্যে একজন হওয়ায়।
আমি মেয়েলি ছিলাম না ,
আমি চাইতাম না
মেয়ে হওয়ার কারণে
আমাকে
হাফটাইমে
মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হোক।

“ও ফুটবল খেলতে পারে না। ও তো একটা মেয়ে।’’
কেন নয়। আমি রাগে
কাঁপতাম।
জোর করে মাঠে ঢুকে যেতাম
আর
কাউকে হাঁটু দিয়ে গুঁতো মারতাম
কারুর চামড়া ঘষটে লাল করে দিতাম
ঘুষি মারতাম কারো হাতে।

কেন আমি খেলতে পারব না?
আমি তোমাদের মতোই ভালো খেলি!

এখন আমি বড় হয়েছি,
আর একটা লক্ষ্মণের গণ্ডি টেনে দেওয়া হয়েছে।

“তুমি কিছু বোঝো না
ছেলেদের আর ফুটবল খেলার ব্যাপারে…’’
অবজ্ঞার সঙ্গে
ঘোষণা করেছিল আমার – শিগগিরি প্রাক্তন-হতে চলা বয়ফ্রেন্ড,

সুতরাং, না,
আমি বুঝি না।
কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম,
যদি তোমরা সবাই
আমাকে বুঝতে দিতে।

রোজমেরি ডান: তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্রে থাকে ফুটবল। জীবনে তিনি একটিমাত্র ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন। ‘প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছিল সেইদিন , খেলা দেখতে খুবই অসুবিধা হয়েছিল।’ সেদিনের কথা বলতে গেলে এটুকুই তাঁর মনে পড়ে। এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে , দুই কন্যা সন্তানের মা , রোজমেরিকে গণ্য করা হয় হাতে গোনা সেইসব কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা পরিচিত ‘the Stroud Football Poets’ নামে। রোজমেরি বলেন যে, ‘পুরুষ আর ফুটবল খেলা নিয়ে প্রচুর পরিমাণে লেখালেখি হয়েছে।’ কিন্তু তিনি ‘ আগ্রহী খেলাটির প্রতি মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে , মেয়েরা কোন চোখে দেখছে ফুটবল খেলাকে সেটা নিয়ে। মাঠের বাইরে থেকে দেখার মতো। ছোটবেলায় ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকলেই ফুটবলে লাথি মারার সুযোগ পেত। ব্যাপারটার মধ্যে একটা অসম্ভব সরলতা ছিল। কিন্তু এরপরেই একটা মুহূর্ত আসত যখন লিঙ্গভেদাভেদের গণ্ডী টেনে দেওয়া হত আর তারপর ফুটবল নামক খেলাটা পরিণত হত ছেলেদের সম্পত্তিতে।’

রোজমেরি তাঁর ‘Different for Girls’ কবিতায় স্মৃতিচারণ করেছেন শৈশবে ফুটবল খেলতে তিনি কতটা পছন্দ করতেন আর এই কারণেই মাঠের অন্য মেয়েরা ( যারা ফুটবল খেলত না) তাঁকে ‘টমবয়’ বা পুরুষালি মেয়ে বলে ডাকত। তিনি আরও বলছেন ‘একটা সময় ছিল যখন আমিও অন্যান্য মেয়েদের মতো টাচলাইনের ধারে দাঁড়িয়ে আমার বয়ফ্রেন্ডকে ফুটবল খেলতে দেখতাম আর তাঁরজন্য কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে রাখতাম যাতে সে হাফটাইমের সময় সেগুলো খেতে পারে।’ পুরুষদের আগ্রাসন আর প্রাচীন প্রবৃত্তির রোজমেরি মৃদু সমালোচক। তিনি বলেন ‘আমি পুরুষদের ঘৃণা করি না, ফুটবল খেলার সময় তাদের আচরণ আমার গোলমেলে লাগে’। তিনি তাঁর লেখায় নতুন প্রজন্মের সেইসব মেয়েদের ব্যঙ্গ করতেও পিছপা হন না ,যারা ফুটবল খেলাটা দেখে থাকে শুধুমাত্র এই কারণে যাতে তারা পুরুষ খেলোয়ারদের সুগঠিত পায়ের প্রশংসা করতে পারে। অবশ্য এরপর তিনি আরও বলেন যে ছেলেরা যদি মহিলা টেনিস খেলোয়ারদের অনাবৃত পায়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে পারে তাহলে এক্ষেত্রেও তিনি দোষের কিছু দেখেন না।
সম্প্রতি ‘The Trouble with Love’ নামে তাঁর একটি উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটেনের ব্রিস্টলে তাঁর বাড়ি। ‘City: Bristol Today in Poems and Pictures’ নামক সংকলন ছাড়াও আরও নানা কবিতা সংকলনে রোজমেরির কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। ভাষানগরের পাঠকদের জন্য রইল রোজমেরি ডানের পাঁচটি কবিতার বাংলা অনুবাদ।