সোমনাথ রায় (Somnath Roy)
ভদ্দরলোকের বাচ্চা (ভাম)
একচল্লিশ ডিগ্রি তাপ-প্রবাহ ডিঙিয়ে বাড়ি ফিরলে
হাট করে খোলা জানলা দিয়ে ঢোকা প্রখর রোদ্দুরে
ঝলসানো ঘরখানা মুচকি হেসে সিলিং-এর পাখা ঘুরিয়ে দিয়েছে
মনে হচ্ছে, কাবাব হওয়ার দোর গোঁড়ায় পৌঁছেছি।
ভাত ঢাকা দেওয়া আছে খাবার টেবিলে।
আহা, খিদে আর একটু চড়লেও গা-মাথা ভিজিয়ে আসায় ভালো
ছাদের পিভিসি ট্যাংকে এখন চায়ের পাতা...
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া (Manidipa Biswas Kirtaniya)
স্পর্শ স্বর
সা লাগাও ফিরসে
মাথার ভেতর ফিসফিস করে কে
গাছের অন্ধকারে জমে থাকে লয়
ক্ষত থেকে শাদারঙ আখর গড়ায়
সুরের ভঙ্গি.. তবে সুর ঠিক নয়
চাকলা ওঠা কাটা দাগ যতটা গভীর
জমাট আঠায় কোঁকড়ানো আর্তনাদ
যতদূর বয়ে নিতে পারো খালি পায়
মরা গান কাঁধে অন্ধ বেহালা ততদূর সুর নিয়ে যায়
ঘোলা লাগে জোছনা...
সন্দীপন চক্রবর্তী (Sandipan Chakrabarty)
অবৈধ স্রোত
কুর্তি গায়ে ফূর্তি এলো নেচে
যদি ফিরতে পারি বেঁচে
এটুক লিখে রাখবো--
তোমায় ভালোবেসেছিলাম
খেয়াল হতেই
হাজার ভয়ে নিজেই নিজের
টিপে ধরছি গলা
চোখের পাতা শুকনো নদী
হঠাৎ রজস্বলা
ঝাঁপাতে গিয়ে তুমি
থমকে গেলে;
বুঝলে কিছু
ঘটেছে গোলমেলে
কথা ছাড়াই বসলে এসে পাশে
হাত ডোবালে স্রোতে--
আঙুল তোমার ছন্দ পেলেই নাচে
হাত তুললে
স্মৃতির ভিতর
থোকায় থোকায় অপারগতা...
রক্ত লেগে আছে
হিংস্র
মানুষ মানুষের মাংস প্রকাশ্যে...
রূপক চট্টোপাধ্যায় (Rupak Chattopadhyaya)
ত্রিবর্ণ
১) নাভিকুন্ড থেকে
ক্ষুধাপদ্ম জেগে ওঠে।
তার তীব্র পরিমলে
ঢলে পড়ে দিনান্তের শ্রমিক পুরুষ!
২) কোনক্রমে
এগিয়ে পিছিয়ে অসমীকরণে
বেঁধে রাখি গনডোয়ানাল্যান্ড!
অন্তরে সব পুরুষেই শালিক পাখি
ষড়ভুজ জীবনের কোনায় কোনায়
উড়ে যায়, ঠোঁটে করে ঘরে আনে
সাঁঝের খড়কুটো, ডানায় ক্লান্তি ঝুঁকি পাড়ে
তবুও দিন থেকে দিনান্ত কাটে দাসত্ব প্রহরী!
৩) সঠিক বিন্দু থেকে অসীম অনন্তের দিকে
খিড়কি খুলে...
মৈত্রেয়ী রায়চৌধুরী (Maitrayee Roychowdhury)
বিজন রোদনা
আমার হাতে কখনও কোনও অস্ত্র ছিল না,
কোন হাতিয়ার নয়,
তবু, এতদিন তিলে তিলে গড়ে তোলা তিলোত্তমা, আমার ইমারৎ
এক প্রহরের সাইক্লোনে কীভাবে ভেঙে গেল!
আর ওই প্রবল ধূসর অবরোধকে যে আড়াল করে রেখেছিল সে উচ্ছল জলধিতরঙ্গ,
এক খরস্রোতা নদী।এতকাল
তা আমি জানতেও পারিনি।
সেই বন্ধনহারা উচ্ছলতা
প্রতিক্ষণে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
অবলোকন করি,
ভেসে...
রোজ রোজ ভুলে যেতে চাই
তবুও সেই অবাধ্য পিছুটান,
প্রতিদিনের আশ্বাসে হারিয়ে ফেলেছি নিজস্বতা,
স্তূপীকৃত জঞ্জাল থেকে তুলে নিয়ে ছিলাম
পরম সমাদরে, গঙ্গাজলে ধুইয়ে দিয়েছিলাম গা,
সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম বাদশাহী আতর।
লুডো খেলায় দানটা চেলে ছিলাম প্রথম থেকেই ভুল।
কখনো কখনো তিন ছক্কা ও তোমাকে
নিরাশ করতে পারে,
সামান্য একটা পুঁট জিতে নেয় জীবনের বাজী।
কেউ খুশি তোষামোদে,
কেউবা আভিজাত্যে...
শুভঙ্কর দাস (Suvankar Das)
জন্ম: ১৯৭৯, শিক্ষা: এম.এ, বি. এড, পেশা: শিক্ষকতা, কবিতা-গল্প-সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৭।
গুপ্তনিবাস
বৃষ্টিভেজা ভোর আসে ঠিক মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার মতো,
আমি কাব্যের পাতাটি জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি
সেইসব রৌদ্রের বাড়ি
যাদের সঙ্গে কবিতার অর্থ নিয়ে হয়েছিল এক জন্ম মতান্তর!
প্রিয় লাল স্কুলবাড়ি,বলতে পারো কোথায় আমার ঘর?
এই ছন্দ, আসলে আমার ভেতরে প্রেম।
এই অলংকার,...
তুষার ভট্টাচাৰ্য (Tushar Bhattachariya)
কলম্বাসের নৌকো
নিঝুম হিমেল রাত্তিরে কলম্বাসের পালতোলা ফাঁকা নৌকো ভেসে আসে ঘুমের শিয়রে ;
আমি তার স্বপ্ন সন্ধানী নাবিক হয়ে
চলে যাই
গঙ্গা পদ্মা মেঘনা যমুনার দুরন্ত
জলস্রোত ভেঙে
শিলাইদহ সাজাদপুরের কুঠিবাড়িতে
সেখানে দেখি দখিন জানালা খুলে
ইজি চেয়ারে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ ;
কিছুক্ষণ পরে নৌকোর বাঁশের লগি ঠেলে চলে যাই বরিশালে
জোছনা আলোয় ভাসা ধানসিড়ি...
দুর্গা বেরার (Durga Bera) জন্ম নদীয়া জেলায়। বারাসাতে থাকেন। ছ'টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটি বইয়ের নাম-- ও নতুন বছর, না বলা কথা, 'ভালবাসি' মুখে বলতে হয় না।
বানভাসি
সুন্দরী ঘেরা সুন্দরবনে- যারা ঝুঁপড়ি কুঁড়েতে থাকে-
ভালো 'বাসা' হীন ওরাই কেবল ভালোবেসে হেসে থাকে।
তোমার যাপন রোদেলা আকাশ, ওদের যাপন মেঘলা।
ওরাই থাকে আঁধার...
দেবাশিস সাহা (Debasish Saha), থাকেন কৃষ্ণনগরে। প্রকাশিত একমাত্র কবিতার বই 'সর্বভূতেষু'। পেশায় শিক্ষক।
একা আর নির্জনবাস
আমাদের দু'জনা মিলে সুন্দর নির্জনবাস
একাকী পিঙ্গলরঙা দোআঁশের ঢিলেমি
মাটির শিকড়ে বাড়ে মৃত ফরাসের অবকাশ
সবই তো দিয়েছ মুছে হে ঈশ্বর হে অন্তর্যামী!
পরজীবী মিথোজীবী অথবা পদস্থল জোড়া
ভেসে গেছে মহাপ্রলয়ে নোয়ার নৌকায়
সপ্ত ঋষির ন্যায় বেঁচে থাকে যতটুকু প্রাণভোমরা
কালোরক্ত বয়ে...
তোমাকে নির্দিষ্ট দিনে কমবেশি বিরহে টেনেছি।
রক্তিমতা, স্রোতের নির্ভার, তোমার দুচোখে দিয়ে
এসে বসি আলগোছে, পিঁড়ি টেনে, উনুনের পাশে...
নদীর বুকের খাঁজে যে ভ্রমর বাসা বেঁধেছিল,
যে আলোর মরীচিকা অতি দূর নক্ষত্রের দিকে
আমাকে টেনেছে, আমি আজ তাকে বিরহেই টানি।
তুমি তো জেনেছ, ভয়, মৃত-সুর, বিপন্নতা, ঘুম—
পুটুস ফুলের মতো তারা, আমারও পথের দুই পাশে
কাঁটা হয়ে...
উত্তম চৌধুরী (Uttam Chowdhury)
জন্ম: ১৯৬২। ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে স্নাতকোত্তর,বি এড। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ২১টি। উল্লেখযোগ্য: শব্দবাহক, সনেট আটচল্লিশ, করতালি ধরে রাখবেন, চূর্ণ কবিতারা প্রভৃতি। পুরস্কার প্রাপ্তি: বিনয় পদক, ত্রিবৃত্ত, চিকরাশি, মন্দাক্রান্তা প্রভৃতি।
টুকরো টুকরো
প্রকৃত আলোর কাছে প্রস্তাবিত দিন সাঁকোর ডামি নিয়ে
সড়ক পেরিয়ে যায়।
ডিএমইউ ট্রেনের মতো দু'মুখো চিন্তায়
ভরে উঠছে যাত্রাপথ, গন্তব্য আর গতিশীল...
শুভ্রাশ্রী মাইতি (Subhrashree Maiti)
শিক্ষিকা। থাকেন পূর্ব মেদিনীপুরে। কাব্যগ্রন্থ-- মনজানালার আকাশ, সুবর্ণসুতোর সম্পর্ক, নিমফুলের নূপুর, মগ্ন জলের মুহূর্তেরা, হারিয়ে যাওয়া নাকছাবিটি।
সৃজন
মা রুটি বেলে
আশ্চর্য কায়দায়
বেলন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
এক একটা নিখুঁত, নিটোল
পূর্ণিমা চাঁদের বৃত্ত; গুঁড়ো গুঁড়ো
জ্যোৎস্না আটার স্বপ্ন, রুটির গায়ে
তেমন রুটি বেলতে পারিনি
আমি কোনদিনও; মায়ের রুটি বেলার
দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি
পৃথিবী গড়ে ওঠে...
প্রায় নারীকণ্ঠে বিলাপের উচ্চতায়
উড়ে যাচ্ছে হৃদয়বেদনাবাহী রিক্সার পর রিক্সা।
নীচে এই শহরের চাপড়া-চাপড়া ত্বক
পড়ে থাকে করুণ মাধ্যাকর্ষণের দিন।
নদীর আকাশে এক তীব্র আলোর ছেদ
দেখা গেল পাখিদের হৃদয়যন্ত্র লেগে
ওই শেষ অস্ত্রোপচার
বেতারে ছড়িয়ে পড়ে
এইভাবে গান
"অর্ধেক নগরী তুমি
অর্ধেক কল্পনা" (পথে প্রবাসে)
প্যারিসে সূর্যের আলো
ক্রমশ সন্ধ্যার রঙে মেশে
ফরাসি ভাষার মতো
নরম, মধুর এই রাত...
তোমার হাসিতে দেখি
মোনালিসা হেসে ওঠে আজ
ল্যুভর মিউজিয়াম ---
ছবির দূরত্ব মুছে যায়!
এদেশে চাঁদের আলো
পূর্ণ মায়ায় মন ভোলে
এখানে একলা মন
বিদেশ ভ্রমণ করে চোখে
এখন মধ্যরাত ----
ওখানে কি চাঁদ ওঠে?
প্যারিসে কি বুদ্ধ পূর্ণিমা?
বালক বয়সে গিঁট খুলতে পারিনি বলে
তোমার তীর্থস্থানটি দেখা হয়নি আমার।
তারপর গোয়ালন্দ স্টিমারঘাট পেরিয়ে উইপোকার মতো অচেনা দেশের মাটি দিয়ে
ঘর বানিয়েছি আমরা ক'জন।
ভাগ্যিস তোমার তোমাকে ছাড়া আর কিছু দেখিনি সেদিন
তাই শুধু অপরূপ মুখশ্রী নিয়ে
আজও তুমি বেঁচে আছো স্রোতস্বিনী কর্ণফুলি হয়ে।
তারপর দিন গেছে মন্বন্তরে
রাত্রি গেছে বেহুলা-ভেলায়।
নিষিদ্ধ মাংসের লোভে কতবার
চরিত্র দূষিত হয়ে...
আজ এই অসমাপ্ত রাতের আধারে
জোনাকি ও তৃণদল, কুয়াশা ও গানের লিরিক থেকে
সময়ের বেশকিছু আগে
জন্ম নিল সবেমাত্র রক্তমাখা ক্ষীণদেহী মেয়ে
এখন দীর্ঘ মাস রেখে দেবে কৃত্রিম উষ্ণতার ঘরে
ছোটো ছোটো পাঁজরের ওপর মসৃণ
ত্বকের আবরণ
ক্ষুদ্র হাত নল দিয়ে ঢাকা
হৃৎপিণ্ড, লাবডুব, দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়
অধীর স্পর্শের গায়ে লীন
অপেক্ষাগুলোকে আজ মুড়ে রাখছে পুতুলবালিশে
উষ্ণতার ঘর...
( আঙ্গিক ঋণ; পিনাকী ঠাকুর )
এখন আছে "আর সে নেই " বাড়ি
পাশের রাস্তা দু-দিক খোলা আজও
শূন্যতা ছোঁয় টগর, বকুল,ঝাউ-ও
ও সান্তনা,তুমি এলে, তুমিও!
জানি, মা কাঁদতে পারছেন না
পিছুটানে জানলা খোলে বোন ---
"কাকাতুয়া, আই, ভুল হচ্ছে কেন ?
দাদা-ই ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত
যথারীতি মায়া-ও আঁকে ছায়া
(আমরা রইলাম সৌজন্য বোধক)
কাজ ফুরোলে পালায় সূর্যি মামা
কোথা থেকে...
কতদিন বৃষ্টি পড়ে না
বুকের পাটায়
সকারণ ভেজেনি পাঁজর
জলের খাতায়
পাঁচিলে শ্যাওলা জমেছে
অবোধ হৃদয়
ঘড়িদাগে সেসব আজ
শুধু অসময়
নিয়েছি দুহাত মাটি, চাক
ঘোরে লাঠির খোঁচায়
জল সরে গিয়ে, পলি
গভীরে, সব দেখা যায়
একটা লোক এই মুহূর্ত থেকে ‘নেই’ হয়ে গেল। নিমেষে
বদলে যাওয়া বাড়ি, তার নিজস্ব এক ঘর, আলনায় গোছানো
পোশাক একইভাবে পড়ে থাকে। বিছানায় শোয়ানো মলিন
হ্যান্ডস্টিক, ঘরের কোণে পানের ডিবে সবাই নিশ্চুপ। একটা
অভ্যস্ত শরীরের গন্ধ ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছে। জানলায় ঝুলে
থাকা না-কাচা পর্দা, ব্যবহারিক খুঁটিনাটি ইত্যাকার অবশেষ
ঘেঁটেও তার হদিশ মেলে না। শুধু,...